দর্পণ ডেস্ক : নানা নাটকীয়তার পর অবশেষে সিলেটের জাফলং ইসিএভুক্ত (ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া) এলাকা থেকে ১২০ কোটি টাকার পাথর লুটের ঘটনায় করা পরিবেশ অধিদপ্তরের এজাহারকে মামলা হিসেবে রেকর্ড করল গোয়াইনঘাট থানা পুলিশ। এজাহার জমা দেয়ার দু’দিন পর গতকাল শনিবার রাতে মামলাটি রেকর্ড করা হয়। পদ হারানো জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরাণ ও জেলা বিএনপির সাবেক কোষাধ্যক্ষ শাহ আলম স্বপনকে প্রধান আসামি করা হয়েছে।
গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমেদ গতরাতে মামলা রেকর্ডের বিষয়টি দৈনিক সিলেটের ডাক পত্রিকাকে নিশ্চিত করেছেন। এছাড়াও একই ঘটনায় পরিবেশ আদালতে আরেকটি পৃথক মামলা দায়ের করা হয়েছে। দুই মামলার আসামির সংখ্যা ১১৪ জন।
পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের পরিচালক মো. ফেরদৌস আনোয়ার সিলেটের ডাককে বলেন, পাথর লুটের ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে দুটো মামলা দায়ের করা হয়েছে। একটি গোয়াইনঘাট থানায় ও অপরটি পরিবেশ আদালতে করা করা হয়।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন, স্থানীয় প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিবেদনের আলোকেই শত কোটি টাকারও বেশি মূল্যের পাথর লুটপাটকারীদের চিহ্নিত করে মামলা করা হয়েছে।বিএনপি’র দুই নেতাসহ ১১৪ জন আসামি জানা গেছে, দেশের অন্যতম সেরা পর্যটন স্পট জাফলং এর পরিবেশ-প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) থেকে ১২০ কোটি টাকার পাথর লুটের ঘটনায় গোয়াইনঘাট থানায় দায়ের করা এজাহারে ৯২ জনকে আসামি করা হয়। তারা হলেন, জাফলং এলাকার চৈলাখেল গ্রামের মঙ্গল মিয়ার পুত্র ও সিলেট জেলা বিএনপির পদ স্থগিত হওয়া যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরাণ, জাফলং বাজারের মৃত হেলাল উদ্দিনের পুত্র সিলেট জেলা বিএনপি নেতা, গোয়াইনঘাট উপজেলা বিএনপির বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক ও বিলুপ্ত হওয়া গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন, কৈকান্দিরপাড়ের সিদ্দিক শিকদারের পুত্র সুমন শিকদার, একই গ্রামের আকবর শিকদারের পুত্র পারভেজ শিকদার ও আব্দুল মজিদের পুত্র রুবেল মিয়া, নয়াবস্তির ইনছান আলীর পুত্র উপজেলা যুবলীগের নেতা আলিম উদ্দিন, মোহাম্মদপুরের মৃত আব্দুল মালেকের পুত্র সিরাজ মিয়া, নলজুরীর আব্দুস সালামের পুত্র সুহেল আহমদ, নয়াবস্তির ইনছান আলীর পুত্র সেলিম আহমদ, জাফলং এর আজিম উদ্দিন, বাউরবাগ হাওরের মনু মিয়ার পুত্র আব্দুল মান্নান, জাফলং এর হুসেন আহমদ, একই এলাকার আব্দুস শহীদ, মামুন, জালাল পীরের পুত্র জামাল, জাফলং এর হাসেম খন্দকারের পুত্র শরীফ, একই এলাকার মুসলিম আলীর পুত্র আইনুল, রুস্তম আলীর পুত্র ইমান আলী, শাহাদাত, আফসর, ফারুক, লোকমান, বিলাল, নয়াগাঙ্গের হাসানের পুত্র মো. জলিল মিয়া, জাফলং এর সিরাজ মিয়ার পুত্র নাসির হুসেন, একই এলাকার ধলু মেম্বারের পুত্র সাদ্দাম, খালিক খন্দকারের পুত্র আব্দুল মান্নান, সৈয়দ আলীর পুত্র চেরাগ মিয়া, মবশ্বির আলীর পুত্র রাজন মিয়া, আব্দুল মজিদের পুত্র আজগর, আব্দুল কাদির, মোতালেব শেখ, মস্তকীন আলীর পুত্র ময়নুল, আস্ত মিয়ার পুত্র শিমুল, তাহির আলীর পুত্র শফিক, ছিদ্দিক মিয়ার পুত্র রানা মিয়া, শফিকের পুত্র চান মিয়া ওরফে চান বাদশা, হুসেন মিয়ার পুত্র দুলাল মিয়া, ছিদ্দিক মিয়ার পুত্র দুলাল মিয়া, সেলিম মিয়ার পুত্র শাকিল মিয়া, একই এলাকার বারিক মিয়া, কনু মিয়ার পুত্র আব্দুল জলিল, মাখই মিয়ার পুত্র আব্দুর রউফ ও আবুল কাসেম, ইমন আলীর পুত্র হবি মিয়া, আব্দুল হামিদের পুত্র সাইদুল, মৃত মন্তাজ আলীর পুত্র মোস্তাফিজুর রহমান লিলু, মৃত মুছব্বির আলীর পুত্র হেলুয়ার আহমেদ, মোক্তার আলীর পুত্র মোতালিব মিয়া, আনফর আলীর পুত্র রুহুল আমিন, সিরাজ উদ্দিনের পুত্র নুরুল ইসলাম, ছৈলাখালের মৃত মঙল
মিয়ার পুত্র হারুন মিয়া, জাফলং এর মৃত মছব্বির আলীর পুত্র মিজবা উদ্দিন, ছৈলাখেলের আহমদ আলীর পুত্র আবুল কালাম ও মৃত বাদশা মিয়ার পুত্র আবু হানিফ, জাফলং এর ফুরকান আলীর পুত্র হেলাল উদ্দিন, হাজী মছব্বির আলীর পুত্র তাজ উদ্দিন, নয়াগাঙেরপারের জলিল মিয়া, মকন মিয়ার পুত্র গিয়াস উদ্দিন, মবশ্বির আলীর পুত্র তারেক রহমান, মস্তাকিন আলীর পুত্র জয়নাল আবেদীন, মাহমুদ আলীর পুত্র আবুল কালাম কাসেম, ছৈলাখেল ৮ম খন্ডের সিদ্দিক মিয়ার পুত্র রানা মিয়া, মৃত মঙল মিয়ার পুত্র মো. শাহজালাল, মাজু মিয়ার পুত্র সেলিম মিয়া, কুনু মিয়ার পুত্র মরম আলী সরকার, নয়াগাঙেরপারের আব্দুল ছালামের পুত্র আবুল মিয়া, জাফলং এর মোশাহিদ ও রাজু আহমেদ, ছৈলাখেল ৮ম খন্ডের আব্দুল খালেকের পুত্র হাবিবুর রহমান, সৈয়দ আলীর পুত্র আতিকুর রহমান, জাফলং এর সিরাজ মিয়ার পুত্র ফাহিম আহমদ ও মনির আলীর পুত্র এরশাদ আলী, ছৈলাখেল ৮ম খন্ডের মাজু মিয়ার পুত্র আব্দুর রব মিয়া, জাফলং এর ফুরকান আলীর পুত্র সিরাজ মিয়া, কুরবান আলীর পুত্র কামাল মিয়া, ছৈলাখেল ৮ম খন্ডের সানু মিয়ার পুত্র মরম আলী, জাফলং এর সিরাজ উদ্দিনের পুত্র শাহজাহান মিয়া, ফরিদ আহমেদের পুত্র আক্তার হোসেন, মাহমুদ আলীর পুত্র আব্দুর রউফ, নয়াবস্তির আতর আলীর পুত্র মরম আলী, ছৈলাখেল ৮ম খন্ডের আলী হায়দারের পুত্র সুহেল রানা, কৈকান্দির পাড়ের মোস্তফার পুত্র সফিকুল ইসলাম, নয়াবস্তির সফিকুল ইসলামের পুত্র ইউনুস মিয়া, আসামপাড়ার আজগর আলীর পুত্র নজরুল ইসলাম, মামার দোকানের হানিফ আলীর পুত্র মহিব উদ্দিন, বাউরবাগের মনির উদ্দিনের পুত্র মো. হান্নান, জাফলং এর জালাল মিয়ার পুত্র মো. জাহাঙ্গীর, ছৈলাখেল ৮ম খন্ডের মুনসুর আলীর পুত্র দুদু মেম্বার ও বাউরবাগের আলা উদ্দিনের পুত্র শাহজাহান মিয়া।
স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, আসামিদের মধ্যে অন্ততঃ ৭০ ভাগই বিএনপির সমর্থক আর বাকি ৩০ ভাগ আওয়ামী লীগের সমর্থক। গতরাত ১১ টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এদিকে, ওই ঘটনায় পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সিলেটের স্পেশাল ম্যাজিস্টেট আদালত (পরিবেশ) ২২ জনের বিরুদ্ধে একটি সিআর মামলা দায়ের করা হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিদর্শক মামুনুর রশীদ বাদী হয়ে এই মামলা দায়ের করেন। আসামিদের রক্ষায় নানা নাটকীয়তা সূত্র জানায়, পাথর লুটের ঘটনায় ৯২ জন আসামির নাম উল্লেখ করে পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেট জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. বদরুল হুদা বাদী হয়ে শুক্রবার সকালে গোয়াইনঘাট থানায় ৭ পৃষ্ঠার একটি এজাহার জমা দেন। সরকারি দাপ্তরিক মাধ্যমে দেয়া ওই এজাহারে পরিবেশ (বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) এর ধারা ৫ লংঘন, যা একই আইনের ১৫(১) এর টেবিলের ২ নং ক্রমিক বিচার্য) আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা উল্লেখ করা হয়। দাপ্তরিকভাবে এজাহার জমা দেয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে এটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করার কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণে সেটি রেকর্ড না করে ড্রয়ারে ফেলে রাখা হয়। এজাহারে উল্লেখিত আসামিদের মধ্যে দু’জনকে বাদ দিতে বাদী পক্ষ তথা পরিবেশ অধিদপ্তরকে এক ধরনের চাপ প্রয়োগ করা হয়। বিষয়টি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এক উপদেষ্টা পর্যন্তও পৌঁছে। পরে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে গোয়াইনঘাট থানার ওসি মামলাটি রেকর্ড করেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। আসামিদের রক্ষায় গেল দু’দিন নানা নাটকীয়তাও করা হয়। আর এই নাটকীয়তায় খোদ প্রশাসনের জনৈক কর্মকর্তাও সম্পৃক্ত বলে সূত্র জানিয়েছে।
গোয়াইনঘাট থানার ওসি সরকার তোফায়েল আহমেদ নাটকীয়তা ও আসামিদের রক্ষার বিষয়টি পুরোপুরি অস্বীকার করেন। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় তিনি বলেন, থানায় লোকবল সংকট প্রকট। মামলাটি বেশ বড়। তাই এটি কম্পোজ করতে বহু সময় লাগার কারণে মামলা রেকর্ড করতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।১২০ কোটি টাকার পাথর লুট
সূত্র বলছে, ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর জাফলংকে ইসিএ ঘোষণার গেজেট প্রকাশ হয়। ২০১২ সালে করা বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই গেজেট প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকে কয়েকটি ধাপে জাফলং থেকে বালু ও পাথর কোয়ারির ইজারা কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছিল। এর মধ্যে বছর বছর পাথর সম্পদ মজুতের বিষয়টি পরিমাপের মধ্যে রাখতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি মাসে সংরক্ষিত এলাকায় পাথরের পর্যবেক্ষণ চলে। সর্বশেষ গত ২৬ জুলাই পরিমাপ অনুযায়ী জাফলংয়ে পাথর মজুত ছিল ৩ কোটি ৭৪ লাখ ঘনফুট। ৫ আগস্ট সেখানে ব্যাপক লুটপাট করা হয়। লুটে নেয়া হয়েছে প্রায় ১ কোটি ঘনফুট পাথর। যার বর্তমান বাজার মূল্য শত কোটি টাকারও বেশি। পাথরের সাথে বালুও লুট করা হয়।
Leave a Reply